বিশেষ প্রতিনিধি
মহাকাশ দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে চীন। একের পর এক মহাকাশযান প্রেরণ করে চীন বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলেছে। তবে চীনের এই চেষ্টার সফলতা তেমন মিলছে না। আন্তর্জাতিক মহলে এ নিয়ে বিপুল কথাবার্তাও হচ্ছে। নজর রাখছে আমেরিকাও। চীন আসলে কি করতে চাইছে এ নিয়ে মহাকাশ বিজ্ঞানীরাও ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না।এরই মধ্যে মার্কিন সেনেটর বিল নেলসন বলেছেন, চীন মহাকাশে বিশাল আকারের ধ্বংসস্তুপ গড়ে তুলছে।
মহাকাশে পাঠানো চীনের লং মার্চ-৫বি হেভী রকেটের ধ্বংসাবশেষ অবশেষে ৯ই মে রবিবার ভারত মহাসাগরের বুকে নিরাপদেই আছড়ে পড়েছে। সকল জল্পনা এবং প্রবল আশাঙ্খার অবসান ঘটিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারানো চীনা রকেটের ধ্বংসাবশেষ ভারত মহাসাগরে ভারত ও শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ভেঙ্গে পড়ে। যদিও পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের পর রকেটের ধ্বংসাবশেষের বেশির ভাগ অংশ আকাশেই ধ্বংস হয়ে যায় এবং কোন ধরণের ক্ষয়ক্ষতি কিংবা প্রাণ হানীর মতো কোন ঘটনা না ঘটিয়েই সাগরের বুকে পতিত হয়।
তবে যাই হোক না কেন মহাকাশে রকেট প্রেরণের পর তার উপর চীনের নিজ নিয়ন্ত্রণ না থাকা এবং তা অনিয়ন্ত্রিতভাবে পৃথিবীর বুকে ফিরে আসার বিষয়টি চীনের মহাকাশ প্রযুক্তি এবং রকেট ইঞ্জিনিয়ারিং এর অদক্ষতা এবং প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার বিষয়টি বিশ্বের সামনে আবারো জড়ালোভাবে প্রকাশিত হলো।
এদিকে চিনের মহাকাশ অভিযান নিয়ে নাসার তরফে সেনেটর বিল নেলসন বলেন, ‘মহাকাশে প্রতিনিয়ত বিশাল আকারের ধ্বংসস্তূপ গড়ে তুলছে চীন। মহাকাশে অভিযান পরিচালনায় দায়িত্ব পালনে একেবারেই ব্যর্থ একটি দেশ হচ্ছে চীন।’ তিনি আরও বলেন, ‘মহাকাশ গবেষণায় যুক্ত দেশগুলির অভিযান সম্পর্কে আরও আধিক মাত্রায় সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। মহাজাগতিক বস্তুর পৃথিবীতে প্রবেশ ও জনজীবনের উপর তাঁর প্রভাব, ঝুঁকির কথা বিবেচনা করেই অন্ততপক্ষে সকলের কাছে স্বচ্ছতা বজায় রেখে মহাকাশে অপারেশন চালানো উচিত।’ চিন এসব কিছুই অনুসরণ করছে বলে মনে হয় না।
১৯৯০ সাল থেকে পৃথিবীতে যতগুলো রকেটের অনিয়ন্ত্রিত রিএন্ট্রি ছিল তার সবই ১০ টনের কম ওজনের। লং মার্চ-৫বি রকেটের কোর ১০০ ফুটের ধ্বংসাবশেষের অংশটির ওজন ছিল প্রায় ১৮ থেকে ২১ টনের কাছাকাছি। তাছাড়া মহাকাশে পাঠানো অচল স্যাটালাইট কিংবা রকেটের অব্যহৃত অংশ এবং ধ্বংসাবশেষ পৃথিবীতে নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে প্রশান্ত মহাসগরের এক বিশেষ প্রত্যন্ত এলাকাকে নব্বই এর দশক থেকেই নির্ধারণ করে রেখেছে বিশ্বের প্রযুক্তি সমৃদ্ধ দেশগুলো। আর রকেট ও অব্যবহৃত স্যাটালাইটের বোন-ইয়ার্ড খ্যাত প্রশান্ত মহাসগরের বুকে সেই অঞ্চলেই মহাকাশে পাঠানো রকেটের ধ্বংসাবশেষ এবং স্পেস জঞ্জাল রকেট প্রেরিত দেশগুলোর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিক্ষেপ করা হয় কিংবা মহাকাশ থেকে ফিরিয়ে আনা হয়।
গত ২৯ এপ্রিল চীনের নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি হেভী ‘লং মার্চ ৫বি’ রকেটটি চীনের হাইনান দ্বীপ থেকে নিজস্ব স্পেস স্টেশনের জন্য তিয়ানহে মডিউল নিয়ে পৃথিবীর কক্ষপথের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। তিয়ানহে মডিউল চীনের নির্মাণাধীন স্থায়ী মহাকাশ স্টেশনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। স্টেশনটিতে তিনজন মহাকাশচারী বসবাসের কোয়ার্টার এই মডিউলটিতে করেই নিয়ে যাওয়া হয়। মহাকাশ স্টেশন স্থাপনের জন্য কক্ষপথে মোট ১১টি মিশন পরিচালনা করবে চীন। এর প্রথমটিতেই লং মার্চ-৫বি রকেটে করে তিয়ানহে মডিউল কক্ষপথে পাঠানো হয়।
লং মার্চ-৫বি রকেটটি মডিউলটি পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক মহাকাশের নির্ধারিত কক্ষপথে স্থাপন করতে সক্ষম হলেও পরবর্তীতে রকেটটির উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারায় চীনের স্পেস গ্রাউন্ড স্টেশন। আর তখন থেকেই এটি বিপদজনকভাবে পৃথিবীর কক্ষপথে চক্কর মারতে থাকে। ১০০ ফুট লম্বা (৩০ মিটার) একটি অংশ রকেট থেকে আলাদা হয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকে জনবসতিপূর্ণ কোথাও আছড়ে পড়লে বড় ধরণের বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারত।
আসলে বিগত তিন দশক থেকে বিশ্বের উদীয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তি রেড জায়ান্ট চায়না শত শত স্যাটালাইট মহাকাশে প্রেরণ করলেও বাস্তবে মহাকাশে প্রেরিত ৫০% থেকে ৬০% স্যাটালাইটের সাথে বর্তমানে চীনের গ্রাউন্ড স্টেশনের কোন যোগাযোগ বা নিয়ন্ত্রণ নেই। সেগুলো মুলত পৃথিবীর লো আর্থ অরবিটে অবিরাম ছুটে চলছে এবং এগুলোর ধ্বংসাবশেষ যে কোন মুহুর্তে পৃথিবীর বুকে আছরে পড়তে পারে। তাছাড়া চীন প্রতিনিয়ত মহাকাশে অসংখ্য স্যাটালাইট প্রেরণ করে যাচ্ছে তা যতটা না কাজের তার চেয়ে অনেক বেশি নিজেকে উচ্চ প্রযুক্তি সমৃদ্ধ দেশ এবং বিশ্ব মানের সুপার পাওয়ার হিসেবে বিশ্বের কাছে নিজেকে প্রমান করা।
চীন কিন্তু এর আগেও ঘটা করে নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি ছোট আকারের দুই বার তিয়ানগং-১ এবং তিয়ানগং-২ মহাকাশ স্টেশন পৃথিবীর লো আর্থ অরবিটে স্থাপন করে। সেগুলো কিন্তু বেশি দিন পৃথিবীর কক্ষপথে টিকে থাকতে পারেনি। কয়েক মাসের মধ্যেই তা আবার প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ভেঙ্গে পড়ে। যদিও তখন চীনের তরফে প্রচার করা হয় যে, এটি ছিল তাদের পরীক্ষামুলক স্পেস স্টেশন এবং ভবিষ্যতে মহাকাশে চীন স্থায়ী স্পেস স্টেশন স্থাপন করবে। এখন সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে সাবেক সুপার পাওয়ার সভিয়েত ইউনিয়নের মতো মীর মহাকাশ স্টেশনের আদলে নতুন করে উচ্চ প্রযুক্তির মহাকাশে স্পেস স্টেশন স্থাপনের কাজ শুরু করে দিয়েছে চীন। আর তাই চলতি ২০২১ সালের ২৯শে এপ্রিল ঘটা করে মহাকাশে তিয়ানগং-৩ স্পেস স্টেশনের প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ মডিউল সফলতার সাথে স্থাপন করে চীনের স্পেস এজেন্সি। পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক এ রকম মোট ১১টি মডিউল পর্যায়ক্রমে মার্চ-৫বি হেভী রকেটে করে মহাকাশে পাঠিয়ে চীন ভবিষ্যতে একক কোন দেশ হিসেবে নিজস্ব স্পেস স্টেশন তৈরি করতে বদ্ধপরিকর। এখন দেখার বিষয়, চীনের তৈরি অত্যাধুনিক স্পেস স্টেশন ভবিষ্যতে কখন এবং কোথায় পৃথিবীর বুকে ভেঙ্গে পড়ে।