--- বিজ্ঞাপন ---

করোনা ভ্যাকসিনের বদলে ভুয়ো টিকা, কলকাতায় তোলপাড়

0

কসবার শিবিরে কোভিশিল্ড কিংবা কোভ্যাক্সিনের মতো টিকা দেওয়া হয়নি। তার বদলে দেওয়া হয়েছে বিসিজি কিংবা হামের টিকা! কলকাতা পুরসভার দাবি, কোভিড প্রতিষেধক দেওয়াই হয়নি। ওষুধ-পাউডারের সঙ্গে জল মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছিল বিসিজি কিংবা হামের টিকা। আর এ নিয়ে চলছে তোলপাড়। তার মধ্যে আগুনে ঘি পড়ার পড়ো অবস্থা হয়েছে এক সংসদ সদস্যও এর শিকার হয়েছে। নাম করা সংসদ সদস্য মিমি চক্রবর্তির ঘুম হারাম হয়ে গেছে।

আনন্দবাজার লিখেছে, খোদ সাংসদ মিমি চক্রবর্তী প্রতিষেধক-প্রতারণার শিকার হওয়ায় শোরগোল সারা রাজ্যে। কিন্তু পুরসভা ও পুলিশের নাকের ডগায় বসে খাস কলকাতায় দিনের পর দিন এমন ভুয়ো ভ্যাকসিনের শিবির চলল কী ভাবে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তার স্পষ্ট উত্তর নেই কোনও। বরং এ নিয়ে কার্যত দায় ঠেলাঠেলি স্বাস্থ্য দফতর, পুলিশ ও কলকাতা পুরসভার মধ্যে। এ দিন প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে পুরসভা জানিয়েছে, কসবার শিবিরে কোভিশিল্ড কিংবা কোভ্যাক্সিনের মতো টিকা দেওয়া হয়নি। তার বদলে দেওয়া হয়েছে বিসিজি কিংবা হামের টিকা!

পুরসভার অতিরিক্ত মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক রণিতা সেনগুপ্তের কথায়, ‘‘কসবার ক্যাম্পে পাওয়া ভায়াল দেখে মনে হয়েছে, সেগুলি কোভিড টিকার ভায়ালের থেকে ছোট। গায়ে নির্মাতার নাম, ব্যাচ নম্বর, ম্যানুফ্যাকচারিং বা এক্সপায়ারি ডেটও নেই!… সম্ভবত পাউডারের সঙ্গে জল মিশিয়ে করোনার নামে বিসিজি বা হামের টিকা দেওয়া হচ্ছিল।’’ প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে এ কথা মনে করা হলেও, সমস্ত নমুনা ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট এলে জানা যাবে, প্রতিষেধক আসল না নকল। নকল হলে কী দেওয়া হয়েছিল?ভুয়ো টিকার খবর সামনে আসার পরে আতঙ্ক ছড়িয়েছে কসবার শিবিরে তা নেওয়া মানুষের মধ্যে। তাঁদের ১১২ জনের মধ্যে ৭০ জনের এ দিনই স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছে পুরসভা।

নীতিতে গাফিলতি মেনে কলকাতার পুর প্রশাসক মণ্ডলীর সদস্য অতীন ঘোষ বলেন, ‘‘যে সংস্থা আবেদন করছে, তাকেই টিকাকরণ শিবির করতে বলা হচ্ছে। এতে জালিয়াতেরা সুযোগ নিচ্ছে। পুরসভা ধীরে ধীরে নিজের কেন্দ্র থেকেই (বেশির ভাগ) টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করবে।’’ একই সঙ্গে অবশ্য তাঁর মন্তব্য, ‘‘স্থানীয়দের সমর্থন ছাড়া এ ধরনের কাজ হতে পারে না। স্থানীয় কোঅর্ডিনেটরের আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।’’ কোঅর্ডিনেটর সুশান্ত ঘোষ অবশ্য ফোন ধরেননি। জবাব দেননি মোবাইলে পাঠানো বার্তারও।

মূল অভিযুক্ত হিসেবে ধৃত দেবাঞ্জন দেব পুলিশি জেরার মুখে জানিয়েছে, অ্যামিক্যাসিন ইঞ্জেকশনগুলি পুরসভার নাম করে বাগরি মার্কেট থেকে কিনেছিল সে। তার কসবার অফিসেই কোভিশিল্ডের নকল মোড়ক ছাপানো হত। পরে ওই ইঞ্জেকশনের ভায়ালে তা লেপ্টে দিত তার চার কর্মী! যাদের আজ, শুক্রবার জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা লালবাজারে। যে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার কাছ থেকে পুরসভার নাম ভাঁড়িয়ে দেবাঞ্জন টাকা আদায় করেছিল, তারা এ দিন অভিযোগ করে তালতলা থানায়। ভুয়ো ক্যাম্প চালানোর পিছনে আর কে কে যুক্ত, কোথা থেকে টাকা আসত, ইত্যাদি জানতে ধৃতকে জেরা করা হচ্ছে। জানা যাচ্ছে, পরে চড়া দরে বেচতে প্রায় ২৫ লক্ষ টাকার মাস্ক, স্যানিটাইজ়ারও বেআইনি ভাবে মজুত করে দেবাঞ্জন।পুলিশের এক শীর্ষ কর্তার বক্তব্য, কোথাও রক্তদান বা প্রতিষেধক শিবির হলে, তার জন্য তাদের অনুমতি লাগে না। তা দেখার দায় পুরসভার। তবে এই ঘটনার পরে লালবাজারের তরফে প্রতি থানাকে সতর্ক করা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রতিষেধক শিবিরে কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখতে।

বুধবারই স্বাস্থ্য দফতরের অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী জানিয়েছিলেন, এই ঘটনায় তাঁদের ভূমিকা নেই। যা বলার পুরসভা বলবে। পুলিশের বক্তব্যও তা-ই। কিন্তু অতীনের দাবি, ‘‘এই ঘটনায় একা পুরসভার উপরে দায় চাপানো ঠিক নয়।… নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে।… এ ধরনের শিবিরের অনুমতি দেওয়ার মালিক নয় পুরসভা।’’

স্বাস্থ্য দফতর-পুলিশ-পুরসভার এই দায় ঠেলাঠেলির মধ্যে বিজেপি প্রশ্ন তুলছে, টিকাকরণের নামে এত বড় প্রতারণা চক্র চালানোর পিছনে দেবাঞ্জন কি একা? বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, “এই রাজ্যে সব কিছু বেআইনি ভাবে চলে ও তা থেকে টাকা কামানো হয়। এ সবের মধ্যে তৃণমূলের নেতারাও যুক্ত। এক জন সাংসদ কী ভাবে এ সব খোঁজখবর না-নিয়ে গেলেন?” প্রশ্ন উঠছে, দেবাঞ্জন পুরসভার কমিশনারের সই করা নোটিস, ফিরহাদ হাকিমের ছবি, পুরসভার স্ট্যাম্প, নথি ব্যবহার করে দিনের পর দিন অফিস চালালেও কেন তা পুরসভার অজানা রইল? স্থানীয় কোঅর্ডিনেটর কী করছিলেন? সমাজ মাধ্যমে বিভিন্ন ছবি তুলে ধরে বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিজেপি নেতাও ইতিমধ্যেই সরব। রাজ্য তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের প্রতিক্রিয়া, ‘‘কলকাতা-সহ সারা রাজ্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার কাজ সন্তোষজনক। এক জন অপরাধ করেছে। পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। নেতাদের সঙ্গে ছবি কিছু প্রমাণ করে না। তা হলে সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়ে সবার পরিচয়পত্র যাচাই করতে হয়।’’

পুলিশ সূত্রের খবর, দেবাঞ্জন এক বার বাগরি মার্কেট থেকে ভায়াল কেনার কথা বলছে, তো কখনও দাবি করছে প্রভাব খাটিয়ে সিরামের কাছ থেকে কেনার। জানা গিয়েছে, মাস্ক, সানিটাইজ়ার, অক্সিমিটারের ব্যবসার সূত্রেই সে শিবিরের আয়োজনে ঢুকে পড়েছিল। তাকে নিয়ে কসবার রাজডাঙ্গার অফিসে গিয়ে বিভিন্ন নথিপত্রও বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ।

তদন্তকারীদের দাবি, ‘প্রভাবশালী’ বলে পরিচিত দেবাঞ্জন সশস্ত্র দেহরক্ষী নিয়ে ঘুরত। চড়ত ‘ভারত সরকারের স্টিকার’ লাগানো গাড়ি। বিরোধীদের প্রশ্ন, সরকারি মদত না-থাকলে, এমন কী ভাবে সম্ভব? তাদের অভিযোগ, ২৬ ফেব্রুয়ারি তালতলায় এক রবীন্দ্র মূর্তি উন্মোচন অনুষ্ঠানের নাম-ফলকে মুখ্য উপদেষ্টা হিসেবে দেবাঞ্জনের নাম রয়েছে প্রথম সারির নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে। কুকীর্তি ফাঁসের পরে তাতে কালো কালি লেপেছেন কেউ। কী করে?

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.