--- বিজ্ঞাপন ---

যুদ্ধের নিশানা বদলে দিতে পারে ফাইটার বিমান

0

::সিরাজুর রহমান::

যুদ্ধের নিশানা বদলে দিতে পারে ফাইটার বিমান। আবার বলা হয়ে থাকে যে কোন যুদ্ধে ফাইটার বিমানের কোন বিকল্প নেই। তাই বিভিন্ন দেশ নিত্য নতুন ফাইটার বিমান বানাতে ব্যস্ত। বিশ্বে ফাইটার বাণিজ্য এখন রমরমা। কে কার কাছে বেশি ফাইটার বিক্রি করতে পারবে তার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত উন্নত দেশগুলো। বাড়ছে চাহিদাও। রাশিয়া সাগরে প্রতিনিধিত্ব করলেও আকাশ পথে ফাইটার বিমানের কিছুটা কমতি ছিল। অবশেষে সকল সমালোচনা ও দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে রাশিয়ার নতুন প্রজন্মের এসইউ-৫৭ সুপার স্টিলথ জেট ফাইটার রাশিয়ার বিমান বাহিনীতে কার্যকরভাবে অন্তর্ভুক্ত করা শুরু হয়েছে। অবশ্য প্রাথমিকভাবে প্রথম ব্যাচে সরবরাহকৃত এসইউ-৫৭ স্টিলথ জেট ফাইটার থেকে রাশিয়ার বিমান বাহিনী হাইপারসনিক এয়ার টু এয়ার মিসাইল ফায়ার টেস্ট সম্পন্ন করবে।

মুলত ২০১০ সালের ২৯শে জানুয়ারি প্রথম প্রটোটাইপ কপির সফল ফ্লাইট টেস্ট সম্পন্ন করা হলেও এসইউ-৫৭ স্টিলথ জেট ফাইটার সার্ভিসে আসতে প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় লেগে গেল। যেখানে বিশ্বের সেরা পঞ্চম প্রজন্মের স্টিলথ জেট ফাইটার হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফ-২২ র‍্যাপ্টার সার্ভিসে প্রথম এসেছে ২০০৫ সালে, এফ-৩৫ লাইটনিং জয়েন্ট স্টাইক সার্ভিসে আসে ২০১৪ সালে এবং চীনের জে-২০ স্টিলথ জেট ফাইটার সার্ভিসে আসে ২০১৭ সালে। বিশেষ করে রাশিয়ার এসইউ-৫৭ স্টিলথ জেট ফাইটারে উচ্চ প্রযুক্তির এইএসএ রাডারের পাশাপাশি ৫-৬ ম্যাক গতি সম্পন্ন ১৫০-৩৯৮ কিলোমিটার রেঞ্জের আর-৩৭এম হাইপারসনিক এয়ার টু এয়ার বিভিআর মিসাইল এবং ১৯৩ কিলোমিটার পাল্লার কে-৭৭ এপিএএ গাইডেড এয়ার টু এয়ার বিভিআর মিসাইল ইনস্টল করায় তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফ-২২ এবং এফ-৩৫ এ ব্যবহৃত এ আইএম-১২০ডি এয়ার টু এয়ার মিসাইলের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে পারে। ২০২৪ সালের মধ্যে মোট ২২টি এবং ২০২৮ সালের মধ্যে মোট ৭৬টি এসইউ-৫৭ স্টিলথ জেট ফাইটার রাশিয়ার বিমান বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৮৩ সালের অক্টোবর মাসে বিশ্বের প্রথম কোন দেশ হিসেবে স্টিলথ প্রযুক্তি সম্পন্ন একেবারেই ব্যাতক্রমি আকার ও ডিজাইনের এফ-১১৭ নাইটহক এট্যাক জেট ফাইটার সার্ভিসে আনে এবং টানা ২৫ বছর সার্ভিস দিয়ে ইউএস এয়ারফোর্স আবার এফ-১১৭ কে ২২ এপ্রিল ২০০৮ সালে অবসরে পাঠিয়ে দেয়। যেখানে কিনা তৎকালীন সময়ে বিশ্বের অন্য কোন দেশ এই জাতীয় স্টিলথ যুদ্ধবিমান ডিজাইন, তৈরি ও ব্যাবহারের বিষয়টি কল্পনাও করতে পারত না। তবে মার্কিন বিমান বাহিনী মোট ৬৪টি এফ-১১৭ সার্ভিসে আনে। সার্ভিসে থাকা কালীন ২৫ বছরে মাত্র একটি এফ-১১৭ নাইটহক স্টিলথ এট্যাক জেট ফাইটার ২৭ মার্চ ১৯৯৯ সালে যুগোস্লাভিয়ায় আকাশে ভূপাতিত হয়েছিল সভিয়েত আমলের এস-২০০ সারফেস টু এয়ার মিসাইল (স্যাম) এর আঘাতে।আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এভিয়েশন জায়ান্ট কর্পোরেশন নরথ্রপ গ্রুম্যানের তৈরি বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও জটিল প্রযুক্তির বি-২ স্পিরিট হেভী বোম্বার মার্কিন বিমান বাহিনী প্রথম সার্ভিসে আনে ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসে। এই জাতীয় হেভী সুপার স্টিলথ বি-২ স্পিরিট বোম্বারের প্রতি ইউনিট কস্ট আনুমানিক ২১০০ মিলিয়ন ডলার। প্রথমে মার্কিন পেন্টাগন ১৩২টি বি-২ স্পিরিট স্টহিলথ বোম্বার তৈরির পরিকল্পনা করলেও অত্যাধিক ব্যয় এবং সময় সাপেক্ষ রিপিয়ার এণ্ড মেইন্ট্যানেন্স বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত মাত্র ২১ বোম্বার এয়ারক্রাফট তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এখনো পর্যন্ত ১৯টি এই জাতীয় স্টিলথ বোম্বার মার্কিন বিমান বাহিনীতে কার্যকরভাবে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে।

তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডেডিকেটেড এয়ার সুপিউরিটি স্টিলথ জেট ফাইটার হিসেবে এফ-২২ র‍্যাপটার সার্ভিসে আনে ২০০৫ সালের ১৫ই ডিসেম্বর। ১৯৯৬ সালে প্রডাশন লাইন চালুর পর থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মোট ১৯৫টি পঞ্চম প্রজন্মের এফ-২২ র‍্যাপটার সুপার স্টিলথ এয়ার সুপিউরিটি জেট ফাইটার সার্ভিসে আনে। যার মধ্য ৮টি ছিল প্রটোটাইপ কপি এবং ১৮৭টি একটিভ জেট ফাইটার এবং প্রতি ইউনিট কস্ট ১৮৭ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লকহীড মার্টিন এভিয়েশন কর্পোরেশন মাল্টি-নেশন প্রজেক্টের আওতায় বিশ্বের ১০টি দেশের সাথে যৌথভাবে এবং এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিজের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ১.৫৩ ট্রিলিয়ন ডলার প্রজেক্টের এফ-৩৫ পঞ্চম প্রজন্মের এয়ার সুপিউরিটি স্টিলথ জেট ফাইটার প্রথম সার্ভিসে আনে ২০১৫ সালে। ২০০৬ সাল থেকে জুন ২০২০ সাল পর্যন্ত মার্কিন লকহীড মার্টিন এভিয়েশন কর্পোরেশন এ, বি ও সি ক্যাটাগরিতে মোট ৫৩৬ টির কাছাকাছি এই জাতীয় সুপার স্টিলথ জেট ফাইটার উৎপাদন করেছে এবং ২০৪৪ সালের মধ্যে মার্কিন বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর ও মেরিন কর্পসের জন্য মোট ২,৪৫৬টি এ, বি, সি এই তিন ক্যাটাগরির এফ-৩৫ লাইটিনিং-২ ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মার্কিন পেন্টগন। তাছাড়া একই সময়ে মোট এক হাজারের কাছাকাছি এফ-৩৫ মার্কিন জোটের সদস্য দেশ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যাণ্ডস, ইসরাইলসহ বেশ কিছু দেশের কাছে বিক্রয়ের মহা পরিকল্পনা নিয়ে ম্যাসিভ উৎপাদনে কাজ করে যাচ্ছে মার্কিন এভিয়েশন জায়ান্ট লকহীড মার্টিন কর্পোরেশন।

তবে মার্কিন প্রশাসনের বাধার মুখে রাশিয়ার এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয়ের বিরোধে জড়িয়ে এফ-৩৫ প্রজেক্ট থেকে ছিটকে পড়েছে তুরস্ক। যদিও এখনো পর্যন্ত এফ-৩৫ ফিউসলেস, ল্যাণ্ডিং গিয়ার, ককপিট ডিসপ্লের বেশ কিছু উচ্চ প্রযুক্তির যন্ত্রাংশসহ প্রায় নয় শাতধিকের কাছাকাছি যন্ত্রাংশ এবং ডিভাইস তৈরি করে তুরস্কের এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাবগুলো। তাছাড়া এফ-৩৫ এর গুরুত্বপূর্ণ এসওএম-জে স্ট্যাণ্ড অফ ক্রুজ মিসাইল তৈরি করছে যৌথভাবে তুরস্কের রকেটসান এবং মার্কিন লকহীড মার্টিন কর্পোরেশন। আর যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথম এফ-৩৫ এর সরাসরি ব্যবহারকারী দেশ হচ্ছে ইসরাইল।বর্তমানে এফ-৩৫ লাইটনিং-২ ‘এ’ ক্যাটাগরির প্রতি ইউনিটের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য ৮০ মিলিয়ন ডলার, ‘বি’ ক্যাটাগরি ১১৫ মিলিয়ন ডলার এবং ‘সি’ ক্যাটাগরির দাম ১০৮ মিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে মজার বিষয় হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে আনুমানিক ১৯৮৩ সাল থেকেই বিভিন্ন ক্যাটাগরির স্টিলথ জেট ফাইটার ও বোম্বার ব্যাবহার করে যাচ্ছে, সেখানে বিশ্বের অন্য কোন দেশ আজ পর্যন্ত কার্যকরভাবে কোন স্টিলথ জেট ফাইটার কিংবা বোম্বার সার্ভিসে আনার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। তবে বর্তমান সময়ে পঞ্চম প্রজন্মের সুপার স্টিলথ জেট ফাইটার ডিজাইন এবং তৈরিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বিশ্বের আরো আটটি দেশ যেমন রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, জাপান, তুরস্ক, ইরান, ভারত, দক্ষিন কোরিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া ব্যাপকভাবে কাজ করে গেলেও এখনো পর্যন্ত মাত্র রাশিয়া ও চীন তাদের তৈরি পঞ্চম প্রজন্মের স্টলিথ জেট ফাইটার আকাশে উড়াতে এবং সীমিত পরিসরে হলেও সার্ভিসে আনতে সক্ষম হয়েছে।

আর এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর রাশিয়া এবং চীন অনেকটাই সফল বলে মনে করা হলেও বাকী দেশগুলো এখনো কিন্তু পড়ে রয়েছে পঞ্চম প্রজন্মের স্টিলথ জেট ফাইটার প্রযুক্তি উন্নয়নের একেবারেই প্রাথমিক স্তরে। বিশ্বের অপর দুই সুপার পাওয়ার রাশিয়া এবং চীন তাদের নতুন প্রজন্মের এসইউ-৫৭ এবং জে-২০ নিয়ে এক দশক ব্যাপী ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে অনেকটা সীমিত পরিসরে সার্ভিসে আনার বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচার করে গেলেও সরাসরি কোন যুদ্ধক্ষেত্রে এর ব্যাবহার এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্নের যথেষ্ঠ অবকাশ থেকেই যাচ্ছে। বিশেষ করে রাশিয়া তাদের বেশ কিছু এসইউ-৫৭ স্টিলথ জেট ফাইটার সিরিয়ার একাধিক ব্যাটল ফিল্ডে পরীক্ষার বিষয়টি মিডিয়ার সামনে বার বার তুলে ধরলেও সিরিয়ায় আসলে কোন বিমান বাহিনী বিহীন এবং অদক্ষ আসাদ বিরোধী হালকা অস্ত্রধারী মিলিশিয়া গ্রুপের বিরুদ্ধে এসইউ-৫৭ এর মতো ডেডিকেটেড পঞ্চম প্রজন্মের স্টিলথ জেট ফাইটারের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা প্রমানের আদৌ কোন সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।এদিকে চীন কিনা আবার তার সুপার স্টিলথ জেট ফাইটার জে-২০ তে সেই আশির দশকের সভিয়েত আমলের এসইউ-২৭ জেট ফাইটারের এএল-৩১এফ ইঞ্জিন লাগিয়ে হলেও বাদুর মার্কা এক স্টিলথ জেট ফাইটার আকাশে উড়িয়ে বিশ্বের বুকে নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে এবং বি-২ স্পিরিটের ক্লোন কপি হং-২০ সার্ভিসে আনার আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছে দেশটি। যা হয়ত আগামী ২০২৮ সালের মধ্যে সার্ভিসে চলে আসতে পারে। অথচ চীন এবং রাশিয়া যেভাবে একেবারেই উম্মুক্তভাবে পুরনো জেট ইঞ্জিন তাদের এসইউ-৫৭ এবং জে-২০ তে ইন্সটল করেছে তাতে তো এমনিতেই উড্ডয়নরত অবস্থায় শত্রু পক্ষের রাডারে জেট ইঞ্জিনগুলো হীট সিকনেচার হয়ে যাওয়ার কথা।

তবে যাই হোক না কেন, ২০৩০ সালের মধ্যে চীন ও রাশিয়ার পাশাপাশি জাপানের মিসিবিস এক্স-২ সিনসিন, তুরস্কের (টিএআই) টিএফ-এক্স, ইরানের কাহার-৩১৩ ভারতের এএমসিএ, যুক্তরাজ্যের বিএই সিস্টেমস ট্যাম্পেস্ট এবং দক্ষিণ কোরিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার যৌথ প্রজেক্টের কেএআই কেএফ-এক্স স্টিলথ জেট ফাইটার সী্মিত পরিসরে হলেও আকাশে ডানা মেলতে পারে। তবে ২০৩০ সালের দিকে হয়ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শতাধিক কোন ষষ্ঠ প্রজন্মের স্টিলথ যুদ্ধবিমান বা বোম্বার বিশ্বের আকাশ দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করে দিলে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু থাকবে বলে মনে হয় না। এদিকে রাশিয়া কিন্তু তাদের একেবারে নতুন প্রজন্মের স্টিলথ প্রযুক্তি সমৃদ্ধ এস-৭০ ওখটিনক-বি কমব্যাট এণ্ড মালটিরোল ড্রোন (ইউএভি) আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে সার্ভিসে নিয়ে আসার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তবে ভবিষ্যতে পৃথিবীর আকাশ মানব বিহীন কমব্যাট এণ্ড নন-ক্যামব্যাট ইউএভি (ড্রোন) এভিয়েশন সিস্টেমের দখলে চলে যেতে পারে এবং বিভিন্ন স্পর্শকাতর এয়ার মিশনে যুদ্ধবিমানে সরাসরি বৈমানিকের ব্যাবহার শুন্যে নেমে আসতে পারে বলে প্রতিয়মান হয়। আশ্চর্যের একটি বিষয় হলো যে, ন্যাটো জোটভুক্ত দেশ তুরস্ক বর্তমানে ছোট বড় মিলিয়ে নিজস্ব প্রযুক্তির ১৩ প্রকারের বিভিন্ন ক্যাটাগরির কমব্যাট এন্ড নন-কমব্যাট ড্রোন ব্যাবহার করে এবং আরো উন্নত প্রযুক্তির কমপক্ষে ৪টি ড্রোন (ইউএভি) সিস্টেম উন্নয়নের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

 

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.