--- বিজ্ঞাপন ---

রিকশার একাল সেকাল

0

কাজী ফেরদৌস#

ফরাসি লেখক ডমিনিক লেপিয়ের এর কোলকাতা শহর নিয়ে লেখা উপন্যাস ” The City of Joy ” পড়ে ছিলাম বহুদিন আগে। বইটিতে বম্বের হিন্দি ছবির সুদর্শন নায়ক মনোজ কুমার এর মত দেখতে  একজন সুদর্শন রিকশা ওয়ালার গল্প ও ছিল। প্রসঙ্গক্রমে উপমহাদেশে রিকশার প্রচলনের গল্প উঠে আসে তাঁর উপন্যাসে।রিকশার প্রচলন প্রথমে শুরু হয় নাকি জাপানে। দুই চাকার গাড়ি মানুষ টেনে নিয়ে যেত।তাই ওটার  জাপানি নাম চিল JINIRIkISHA  অর্থ মানুষে টানা গাড়ি। ১৮৬৯ সালে জাপানে এটা প্রথম আবিষ্কার ও প্রচলন হয় বলে উইকিপিডিয়ায় তথ্য পাওয়া যায় ।পরে এটা এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে ও জনপ্রিয় বাহন হয়ে উঠে। এই মানুষে টানা গাড়ি টি লেপিয়ের এর মতে ত্রিশ এর দশকে প্রথম নাকি ভারতের পাহাড়ি শহর সীমলায় চালু হয়।পরবর্তী তে কোলকাতা শহরে রিকশা (Rikshaw)নামে চালু হয়।এখনো কোলাতা শহরে মানুষে টানা দু’চাকার রিকশা প্রচলিত আছে। তবে আমাদের দেশে বলবিয়ারিং যুক্ত তিন চাকার প্যাডেল দেওয়া রিকশা সম্ভবত ঢাকাইয়া আবিষ্কার।চল্লিশের দশকের শুরুতেই সম্ভবত যার সূচনা। এর আগে ঢাকা শহরের প্রধান বাহন ছিল গোড়ার গাড়ি। চট্টগ্রাম শহরে ও ঘোড়ার গাড়ি ব্যাপক প্রচলন ছিল। এমনকি ষাটের দশকের মাঝামাঝি  সময়েও আমি ঘোড়ার গাড়ি চড়ে ফৌজদার হাট সী বিচে গিয়েছিলাম এক বন্ধু সহ।পাঁচ টাকা ভাড়া নিয়েছিল।মনে আছে পঞ্চাস এর দশকের মাঝামাঝি কোন সময় আমি আর আমার বড় বোন জাহানারা (খুকী) বড় দুলাভাই এর সাথে পতেঙ্গা থেকে কালুরঘাট এসেছিলাম। যতটুকু মনে পরে তিন কি চার টাকা ভড়া নিয়ে ছিল। ষাটের দশকের শেষ প্রান্তে এসে রিকশা ও বাস সার্ভিস ও বেবিট্যাক্সির সাথে পাল্লা দিয়ে টিকতে না পেড়ে ঘোড়ার গাড়ি উঠে যায় ঢাকা চট্টগ্রাম সহ সব শহর থকে।ঘোড়ার গাড়ির মালিক রা ঘোড়া গুলো তখন রাস্তায় ছেড়ে দেয়।মালিক বিহীন ঘোড়া গুলো রাস্তায় ইতস্তত ঘুরে বেড়াত আর ডাস্টবিন থেকে খাবার কুড়িয়ে খেত।একবার দুই বন্ধু মিলে পরিকল্পনা করে ছিলাম এরকম একটা ঘোড়ায় চড়ে শহর ঘুরে বেড়ানোর। কিন্তু সাহসে কুলোয় নি।

চট্টগ্রাম শহরে প্রথম যখন আসি তখন আমার বয়স সম্ভবত ছয় বছর।চট্টগ্রাম শহরের  তিনটি বৈশিষ্ট্য আমার শিশু মনে গেঁথে গিয়েছিল। একটা কাকের কা কা শব্দ আর রিকশার পোঁ পোঁ শব্দ আর নালা থেকে নির্গত দুর্গন্ধ। আমার গ্রামীণ জীবনে তিনটিই ছিল দুর্লভ অভিজ্ঞতা । বিকেলে আর এক অভিজ্ঞতা যোগ হল সড়ক বাতি।প্রথমে মনে হয়েছিল সারি সারি সাদা আইসক্রিম। খুব অবাক হয়ে ছিলাম! রিকশায় তখনও ক্রিং ক্রিং বেল লাগে নি। বাসের মত পোঁপোঁ করে ভেঁপু বাজত।

একটা সময় ছিল রিকশাই ছিল নগর জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। রিকশা ছাড়া নগর  জীবন কল্পনা ও করা যেতনা। ঢাকা কে বলা হত রিকশার শহর।মধ্যবিত্ত মানুষের নগর জীবনের অন্যতম অনুসঙ্গ ছিল রিকসা।রিকসা ছাড়া তখন নগর জীবন ছিল কল্পনার ও বাইরে। নব্বই এর দশকের কোন এক সময় ঢাকায় নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ছিলেন ডেভিড মেরিল।তিনি ঢাকার রংবেরঙের রিকশা ও তার হুডে আঁকা চিত্র কলা নাকি  বেশ উপভোগ করতেন।তিনি রিকশার হুডের চিত্রকলার ও বেশ অনুরাগী ছিলেন। এক ঈদে তাঁর শখ হল তিনি রিকশা চালকের বেশে  ছবি তুলে সেই ছবি দিয়ে ঈদ শুভেচ্ছা কার্ড ছাপবেন। এবং করলেন ও তাই। সম্ভবত সপ্তাহিক বিচিত্রা সুট পরিহিত রিকশা ওয়ালা মেরিল এর ছবি দিয়ে তাদের ফ্রন্ট কভার করেছিলেন রিকশা ওয়ালা মেরিল ক্যাপসন দিয়ে।

রিকশার গৌরবময় অতীত এখন শেষ হয়ে আসছে মনে হয়।যন্ত্রের সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে হয়ত একদিন ঠাঁই নেবে যাদুঘরে ঘোড়ার গাড়ি বা গরুর গাড়ির মত।তবুও আমাদের প্রজন্ম বা পরবর্তী আরো কয়েক প্রজন্মের মানুষের স্মৃতি হয়ে থাকবে এই রিকশা। হয়তো বা কারো স্মৃতিতে ভেসে বেড়াবে প্রমিকার সাথে বা নব পরিনিতার  সাথে রিকশা চড়ে শহর  ঘুরে বেড়ানোর রোমান্টিক স্মৃতি।#

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.